অম্বানি, আদানি-আঁতাতের অভিযোগে এবার বিদ্ধ কংগ্রেস! ভোটবাজারে বারবার কেন বেফাঁস মোদি?

Narendra Modi: যে আদানি-অম্বানিদের সঙ্গে মোদির এত দহরম-মহরম, সেই আদানিদের এখন কংগ্রেসের ঘাড়ে ঠেলার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে গেরুয়া শিবির। উত্তর একটাই, ভোট। এবার তেলঙ্গানায় নতুন বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন মোদি।

লোকসভা ভোট যত এগোচ্ছে, ততই আগ্রাসী ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। লোকসভা ভোটে এবার চারশো আসন জেতার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আসরে নেমেছে বিজেপি। বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য় বলছেন, চারশো আসন জেতা মোটেও সহজ হবে না গেরুয়া শিবিরের পক্ষে। রামমন্দির স্থাপন, তার এলাহি উদযাপন থেকে শুরু করে বছরভর হিন্দুত্ববাদী একগুচ্ছ ভোটমুখী পরিকল্পনা আগে থেকেই কষে রেখেছিল বিজেপি। তেমনটাই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। তার পরেও কি লোকসভা ভোটের বহু আসন নিয়ে সংশয়ে বিজেপি? লোকসভা ভোটের মাঝে বারবার সংখ্যালঘুকে আক্রমণ করে হিন্দু পকেটের ভোটকেই তাই আরও নিশ্চিত করে তুলতে চাইছেন মোদি? উঠছে তেমনই প্রশ্ন। এবার আরও একধাপ এগিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আদানি, অম্বানি-আঁতাতের অভিযোগ তুললেন মোদি। বললেন, গৌতম আদানিদের থেকে ঘুষ নিয়েই নাকি তাঁদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো বন্ধ করেছে কংগ্রেস। 

কিছুদিন আগেই সংখ্যালঘুদের ঘুসপেটিয়া বলে তোপ দেগেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কংগ্রেসকে আক্রমণ করতে গিয়ে বলে বসেছিলেন, কংগ্রেস নাকি ক্ষমতায় এলে সাধারণ মানুষের সোনাদানা সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তা সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে। মোদির সেই বক্তব্য ঘিরে কম বিতর্ক হয়নি। কংগ্রেসের ইস্তেহার সামনে আসার পর থেকে অস্বস্তি বেড়েছে মোদির। বারবার প্রায় প্রতিটি ভাষণেই কংগ্রেসকে এক হাত নিচ্ছেন মোদি। সম্প্রতি মদ্যপ্রদেশে সভায় গিয়ে মোদি এ-ও বলে বসেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে নাকি বাবরি মসজিদের খোলা তালা এনে রামমন্দিরে ঝুলিয়ে দেবে তারা।

আরও পড়ুন: মোদি আর বিজেপি দুই-ই এবার ব্যাকফুটে || মুখোমুখি পরাকলা প্রভাকর

ভোটের আগেই মোদি জমানার 'সবচেয়ে বড়' দুর্নীতির উপর থেকে পর্দা উঠেছে। ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্পের মাধ্যমে কীভাবে রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের কোষাগারকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলেছে, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার প্রকাশ করা নথিপত্রতে। সেই প্রকল্পকে সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক বলে জানিয়ে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। স্বাভাবিক ভাবেই সেই প্রকল্প থেকে সব থেকে বেশি লাভবান হয়েছিল বিজেপি। তার পরে তালিকায় ছিল তৃণমূল ও কংগ্রেসও। ভোটের মুখে সেই দুর্নীতি নিয়ে যথেষ্ট চাপে পড়েছিল বিজেপি। তারপর আদানিদের সঙ্গে মোদি ঘনিষ্ঠতার ঘটনাও প্রায় সর্বজনবিদিত। সেই আদানিকে নিয়ে লোকসভায় প্রশ্ন করে বিপাকে পড়েন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। শুধু মহুয়াই নয়, কংগ্রেস নেতানেত্রীরাও মোদি-আদানি ঘনিষ্ঠতা নিয়ে প্রায়শই বিঁধে এসেছে বিজেপিকে।

যে আদানি-অম্বানিদের সঙ্গে মোদির এত দহরম-মহরম, সেই আদানিদের এখন কংগ্রেসের ঘাড়ে ঠেলার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন গেরুয়া শিবির। উত্তর একটাই, ভোট। এবার তেলঙ্গানায় ভাষণ দিতে গিয়ে নতুন বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন মোদি। তাঁর বক্তব্য, আদানি-অম্বানিদের থেকে মোটা অঙ্কের কালো টাকা ঘুষ খেয়েই সেই সমস্ত আক্রমণ থেকে নিজেকে সরিয়ে এনেছে কংগ্রেস। মোদির মতে. রাহুল গান্ধি রাতারাতি আদানির বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন, তার নেপথ্যে আসলে রয়েছে টাকার খেলা।

দীর্ঘদিন ধরেই মোদি সরকারের বিরুদ্ধে শিল্পপতি আদানির পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগ জানিয়ে এসেছে কংগ্রেস। একের পর এক সরকারি সংস্থার বেসরকারিকরণ থেকে শুরু করে আদানিকে একের পর এক সরকারি টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ানোর মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে। আদানি দুর্নীতি ও মোদির পৃষ্ঠপোষকতা সংক্রান্ত একটি তদন্তরিপোর্ট তৈরি করেছিল মার্কিন সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ। সেই তথ্য সামনে আসতেই বিরোধীদের হাতে আরও বড় সুযোগ চলে এসেছিল মোদি-বিরোধীতার। আর সেই সুযোগের সদ্ব্যবহারও ভালো মতোই করেছিল কংগ্রেসের মতো বিরোধী দলগুলি। গৌতম আদানির সংস্থা আদানি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির বিরুদ্ধে অ্যাকাউন্ট জালিয়াতি, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার মতো সব অভিযোগ তোলা হয়। যা নিয়ে ভালোই অস্বস্তিতে পড়েছিল বিজেপি।

বুধবার তেলেঙ্গানার করিমনগরের একটি জনসভায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ফের আক্রমণ শানালেন মোদি। এবার আর শুধু সংখ্যালঘু তোষনের অভিযোগ নয়। আদানি নিয়ে আক্রমণ না শানানোর মূলে যে রয়েছে কংগ্রেসের ওই শিল্পপতিদের কাছে থেকে আর্থিক সাহায্য নেওয়া, তা সপাটে জানিয়ে দিলেন মোদি। অথচ সেই ২০০৩ সাল থেকে মোদির সঙ্গে গৌতম আদানির ঘনিষ্ঠতা কারওর চোখ এড়ায়নি। মোদির 'ভাইব্র্যান্ড গুজরাট' প্রকল্পের প্রধান কান্ডারী ছিলেন আদানিই। গোধরা কাণ্ডের পর গুজরাটে মোদির হারানো গৌরবকে ফেরাতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি তিনি। শুধু কি তাই, মোদি তার মেয়াদের প্রথম চার বছরে মোট ৪১টি দেশে সফর করেন। প্রায় সেই সমস্ত সফরেই প্রধানমন্ত্রীর ব্যবসায়িক সঙ্গী ছিলেন হয় আদানি, নয় অম্বানি। এই দুই ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্বের সংস্থাগুলির সঙ্গে অন্তত ১৬টি দেশে ১৮টি চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে এই পর্বে। শুধু প্রধানমন্ত্রী মোদির নয়, মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, সে সময়েই কেনিয়া বা উগান্ডা সফরে তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন এই সব বড় ব্যবসায়ীরা। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যে বিপুল খরচ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল মোদি জমানায়, তার মধ্যে বহু ক্ষেত্রেই লাভবান আদানি এবং অম্বানি। বিশেষত বিমান তৈরির জন্য যেসব বড় সংস্থা টেন্ডার পেয়েছে, তার মধ্যে অধিকাংশই আদানি বা অম্বানিক সংস্থা। প্রতিরক্ষা বাড়াতে রাফাল বিমান কিনতে ফ্রান্সের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল ভারতের, তার সুবিধা পেয়েছিল অনিল অম্বানি। ভারতে একক ইঞ্জিনের যুদ্ধবিমান তৈরির জন্যেও আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তি করেছিল মোদি সরকার। অনিল অম্বানির রিলায়েন্স ডিফেন্স প্রায় ৬৫,০০০ কোটি টাকার চুক্তি করে ইজরায়েলের সঙ্গে, এয়ার টু এয়ার মিসাইল প্রযুক্তির আনার জন্য। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করতে বিমানপ্রতিরক্ষা সংক্রান্ত যে চুক্তি হয়েছিল, সেখানেও অংশীদার ছিল রিল্যায়েন্স ডিফেন্স। আমেরিকা, জাপান, ইরান, অস্ট্রেলিয়া-সহ একাধিক দেশের সঙ্গে নানাবিধ চুক্তি করেছে ভারত। যার থেকে লাভবান হয়েছে হয় আদানি নয় অম্বানি।

আরও পড়ুন: অযোধ্যায় চাষিদের ঠকিয়ে, কোটি কোটি টাকায় জমি বিক্রি করা হয়েছে আদানি গোষ্ঠীকে?

অথচ ভোটের বাজারে এই আদানিদেরই নিজের থেকে দূরে ঠেলছেন মোদি। শুধু দূরেই ঠেলছেন না, চাপিয়ে দিচ্ছেন কংগ্রেসের ঘাড়েও। বুধবারের ওই জনসভায় মোদিকে বলতে শোনা যায়, আদানিদের থেকে ঠিক কতগুলো ব্যাগ কালো টাকা পৌঁছেছে কংগ্রেসদের কাছে? তাঁর জিজ্ঞাসা, কেন কংগ্রেস রাতারাতি আদানি-অম্বানিকে গালাগাল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে? তার অর্থ কংগ্রেসের কাছে এসে পৌঁছেছে আদানিদের চুরির টাকা! দেশ সেই প্রশ্নের জবাব চায় বলেই দাবি করেছেন এদিন মোদি। স্বাভাবিক ভাবে মোদির এই বক্তব্য ঘিরে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে রাজনীতি মহলে। লোকসভার তিন দফার ভোটগ্রহণ ইতিমধ্যেই সারা। ১৩ মে, ২০ মে, ২৫ মে এবং ১ জুন, বাকি চার দফার ভোট। আর সেই ভোট যত কাছে আসছে, ততই মোদির অস্থিরতা বাড়ছে বলে দাবি করেছে ওয়াকিবহাল মহল। ইতিমধ্যেই মোদির একাধিক বক্তব্য ঘিরে বিতর্ক বেঁধেছে। অভিযোগ জমা পড়েছে নির্বাচন কমিশনেও। তবে এখনও তার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করেনি কমিশন। লোকসভা ভোটে চারশো আসন দখলের যে দাবি পদ্মশিবির করেছে, সেই জায়গাটা নড়বড়ে দেখেই কি এতটা মরিয়া বিজেপি? উঠেছে প্রশ্ন।

More Articles