গত চারমাসে ১৪৮ বার শাস্তি! বিজেপির বিরুদ্ধে বললে কী কী করেছে মোদি সরকার?

Modi Against Freedom of Speech: উত্তরাখণ্ড বাকস্বাধীনতা হননের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, এই রাজ্যে ১০টি ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। এরপরেই রয়েছে হরিয়ানা।

গত কয়েক মাসে ধরে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নানা তথ্য সামনে আসছে লোকসভা নির্বাচনের বাজারে। ইলেক্টোরাল বন্ড, কেন্দ্রীয় সংস্থার একতরফা মামলা, শাসক দলের নেতাদের মামলা চাপা দেওয়া সহ কর্ণাটকের লোকসভার প্রার্থীর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ। সম্প্রতি রাজস্থানে প্রধানমন্ত্রীর ঘৃণামূলক বক্তব্যের জন্য ২,২০০ টি অভিযোগপত্র জমা পড়েছে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে। বিরোধীরা অভিযোগ তুলছিল, বিরোধী দলগুলিকে দুর্বল করতে বিরোধী দলের প্রধান নেতৃত্বদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। অন্যদিকে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। ভারতের নির্বাচনী আবহে 'ফ্রি স্পিচ কালেকটিভ' বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে চারমাসে ১৪৮ বার বাকস্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। ভারতের সংবিধানের ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। 'ফ্রি স্পিচ কালেকটিভ'-এর রিপোর্টে উল্লিখিত ১৪৮ টি বাকস্বাধীনতার মধ্যে রয়েছে, সাংবাদিকদের উপর 'আক্রমণ', সাংবাদিকদের উপর 'নির্যাতন', সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে আইন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ ইত্যাদি।

গত চার মাসে ৩৪ জন সাংবাদিকের উপর হামলা নিয়ে 'ফ্রি স্পিচ কালেকটিভ'-এর তদন্তমূলক রিপোর্টে লেখা হয়েছে, ২০২৪ সালে এখনও অবধি ৫ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আপাতত ৩ জনের জামিন হয়েছে। রিপোর্টে কাশ্মীরি সাংবাদিক আসিফ সুলতানের কথাও উল্লেখ রয়েছে। এই সাংবাদিককে জামিন হওয়ার চার দিন পর ফের গ্রেফতার করা হয়েছিল। লেখা হয়েছে, কীভাবে 'The Caravan'-এ প্রকাশিত 'Screams from the army post' শিরোনামের প্রতিদিবেদনটি সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল সরকারের তথ্য এবং সম্প্রচারক মন্ত্রক। 'ফ্রি স্পিচ কালেকটিভ'-এর রিপোর্টটিতে আলোচিত হয়েছে, প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলি পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ প্রকাশ করছে যেখানে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলি হুমকির মুখে রয়েছে। এখানে সংবাদমাধ্যম 'নিউজক্লিক' এবং তার প্রতিষ্ঠাতা প্রবীর পুরকায়স্থর কথাও উল্লেখ রয়েছে।

আরও পড়ুন- কংগ্রেস নয়, মোদি জমানাতেই বেশি সোনা খুইয়েছেন মানুষ! প্রকাশ্যে যে ভয়ানক তথ্য

বলা হয়েছে, বিনোদন, সোশ্যাল মিডিয়া, শিক্ষাক্ষেত্র এবং সংবাদমাধ্যম জুড়ে মোট ৪৬ টি সেন্সরশিপ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ লেখা হয়েছে, জানুয়ারিতে অযোধ্যার রামমন্দির উদ্বোধনের সময়কালে প্রায় শতাধিক সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ব্লক করা হয়েছিল। হরিয়ানার কৃষক আন্দোলনেও একই পদক্ষেপ করা হয়েছিল বলে উল্লেখ রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৯এ ধারায় ১৪ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় তথ্য এবং সম্প্রচার মন্ত্রকের নির্দেশে ১১৭ টি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট এবং ওয়েব লিঙ্ক ব্লক করা হয়েছিল। উল্লেখ রয়েছে, 'মাঙ্কি ম্যান' সিনেমাটি বিশ্বজুড়ে প্রকাশ পেলেও, ভারতে প্রকাশের অনুমতি পায়নি। রিপোর্টে শিক্ষাক্ষেত্রে ২৪ টি বাকস্বাধীনতা খর্ব হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলেও লেখা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আলোচিত হয়েছে, মুম্বইয়ের একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকের কথা যিনি প্যালেস্টাইনের সমর্থনে ট্যুইট করেছিলেন বলে তাঁর উপরও হামলা করা হয়। এছাড়া, 'রাম কে নাম' তথ্যচিত্র প্রদর্শনের জন্য হামলার কথাও বলা হয়েছে। এই তথ্যচিত্র প্রদর্শনের জন্যই টাটা ইন্সটিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সেসের ক্যাম্পাস থেকে পিএইচডি স্কলার রামদাসকে দু'বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। 'Bolta Hindustan' নামের ইউটিউব চ্যানেলটি মোদি সরকারের সমালোচনা করায় বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

উত্তরাখণ্ড বাকস্বাধীনতা হননের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, এই রাজ্যে ১০টি ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। এরপরেই রয়েছে হরিয়ানার নাম। এই রাজ্য ইন্টারনেট অবরোধের তালিকায় শীর্ষ। কৃষক আন্দোলনের সময় এই রাজ্যে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছিল। তারপরে রয়েছে পঞ্জাব এবং মণিপুরের নাম। এই রাজ্যগুলিতে পরিস্থিতি সামাল দিতে ইন্টারনেট সংযোগ অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। যদিও ২০২৩ সালে মণিপুরে, মে থেকে ডিসেম্বর দীর্ঘ সময় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করেছিল সরকার।

আরও পড়ুন- ২০০৩-২০২৪: যে ভাবে বারবার মুসলিম-ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে

প্রসঙ্গত, আগেও বহুবার সাংবাদিকদের উপর আক্রমণের অভিযোগ উঠেছে নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, উপযুক্ত কারণ ছাড়াই সংবাদমাধ্যম 'নিউজক্লিক' এবং 'বিবিসি'-তে একাধিকবার অভিযান চালায় কেন্দ্রের অধীনে থাকা তদন্তকারী সংস্থাগুলি। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সরকার বিনা বিচারে ভারতীয়দের জেলে বন্দি করে রাখত। ১৮৯১ সালে 'বঙ্গবাসী' পত্রিকার সম্পাদক রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সঙ্গে সংযুক্ত আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল। প্রশ্ন উঠছে, দেশে যদি গঠনমূলক সমালোচনা করার পরিস্থিতি না থাকে, সরকারপক্ষ যদি এখনও বিরোধী কণ্ঠরোধই করে তবে স্বাধীনতার আগে এবং পরের পরিস্থিতির পার্থক্য ঠিক কোথায়? 'প্রেস ফ্রিডম' তালিকায় ভারতের অবস্থান প্রতিবেশী পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সহ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত একাধিক দেশেরও নীচে নেমে গিয়েছে। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী প্রায় সর্বত্রই পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা টানে। কিন্তু নেতারা হয়তো ভুলে যান, বাস্তব চাপা দিতে গিয়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের থেকেও পিছিয়ে যাচ্ছি আমরা। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। দেশের সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার। প্রশ্ন উঠছে, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে, শিক্ষাক্ষেত্রেও স্বাধীনতায় আঘাত করেই কি মোদি সরকার '৪০০ পার'-এর কৌশল করেছে? এই রিপোর্ট সামনে আসার পরও কি কেউ জিজ্ঞেস করবে না, 'রাজা তোর কাপড় কোথায়?'

More Articles